আজি হসন্ত জাগ্রত দ্বারে

 অ্যান্টেনার কাক থেকে ছাতিম ফুল, অমিত রায় থেকে বেনীমাধব সবাই তঠস্হ। লাল বেলুন, পিট্যুইটারীর ভাদ্র মাস আর বুকে ঝিলমিল যশ চোপড়া নিয়ে এসে গিয়েচে সন্ত ভ্যালেন্টাইনের ফিস্টি। কামদেব আর কিউপিড মনোজ কুমারের পুব পশ্চিম ঝগড়া থামিয়ে যে যার তীর বাগিয়ে ফুল রেডি। সিঙ্গেল রূপেন সংস্থিতা পাশের রকের পিন্টু সানি দেওলের হ্যান্ড পাম্পের কসম খেয়েছে যে আজ যদি টিউশান ফেরত একটিবার 'পলট পলট পলট' হয়ে যায় তাহলেই ব্যাস ফেসবুকের রিলেশানশিপ স্ট্যাটাসটা সটান বদলে হবে 'কমিটেড'। তারপর না হয় পাগলী তোর সঙ্গে সেলফিক্লান্ত কাটাব জীবন। মোদ্দা কথাটা হল সব্বাই রেডি ভালবাসাবাসির উল্লাস যাপনে। বজরং দল রেডি যুগলদের হিন্দুমতে বিয়ে দিতে, ফ্যাতাড়ুরা রেডি শিবসেনার মাথায় হাগতে, কামুক বন্দ্যোপাধ্যায় রেডি রানু ভানুর কেচ্ছা কীর্তনে, লেকমার্কেটের রাকেশদা রেডি কাঁটা বেছে লং স্টেম গোলাপ নিয়ে, আর হাল ছেড়ে দেওয়া সিঙ্গেলরা রেডি জগন্নাথের পূজায় বসতে।


দ্যাখো আমি বাড়ছি মামি

আমরা যারা নব্বইএর দশকে বড় হয়েছি, ভালবাসা কথাটা শুনলেই যাদের প্যাভলভের কুকুরটার মত বাঁ কানে ম্যান্ডোলিন, ডান কানে ভায়োলিন আর চোখে সর্ষের ক্ষেত ভাসে; ইকোনমিক লিবারালাইজেশান যাদের জন্ম দিয়েছে এবং লেট ক্যাপিটালিজম আর কেবল টিভি যাদের কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছে তারা ভালবাসা নিয়ে কথা বলতে গেলেই নস্টালজিয়ার পিটুলিগোলা বুঝিপ্রথম প্রেম, প্রথম চুমু, চিলেকোঠা, মিক্স টেপ, দার্জিলিংএর অঞ্জন দত্ত, আর অঙ্কের খাতার পিছন পাতায় লেখা কবিতার চিরচেনা ক্লিশে ঘেরাটোপটার বাইরে বেরোতেই পারি না। এই অক্ষম আহাম্মকের দলে আবার যারা একটু বেশি স্মার্ট হই তারা একটু বড় হওয়ার পর শোনা বব ডিলান বা কোহেন কে এমন ভাবে আপন করে নিই যেন ভাবখানা হল 'প্রথমবার প্রেমিকার হাত ধরেছিলাম উডস্টকের মাঠে'। বেলা বোস, রাহুল, আর নীলাঞ্জনার ত্রিকোণ প্রেমটা থেকে দূরে থাকার চেস্টা জারি থাকুক অতঃপর।

কম্ফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস কেন এই প্রশ্নের আপাতত একটাই যুতসই জবাব খুঁজে পাচ্ছি। এবার সত্যই কতগুলো সত্যি মেনে নেওয়ার সময় এসেছে- প্রথমত, মার্ক যুকেরবার্গ ১৯৮৪ এ জন্মেছে বলে ফেসবুকে এখনও 'নাইন্টি'স কিড' কথাটা বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এবার কি 'কিড'টা একটু সরালে ভাল হয় না? ট্রেনে বাসের ভিড়ে সাম্নের জনকে ভুল করে কাকু বলে ডেকে ফেললে কিন্তু বেশ জোরালো কটমট চাউনি মেলে আজ কাল। দ্বিতীয়ত প্রথম প্রেম, প্রথম বিরহী ব্রেক আপ নিয়ে যে প্লেটো সুলভ ভাবাপ্লুত হয়ে পড়ার চল আছে আমাদের সেটা এবার বন্ধ না করতে পারলেও অন্তত আবেগের পরিমানটা কমানো উচিত। বা তাও না পারলে এটুকু এবার মেনে নেওয়া উচিত যে প্রথম প্রেমের কারুবাসনা কালে হোমোফোবিয়ার মাত্রা ছিল প্রবল আর প্রথম বিচ্ছেদে ছিল না জানি কত কুইন্টাল মিসোজিনি। যাক্গে মিসোজিনি থেকে মনে পড়ে গেল এবছর বজরং দল ঠিক করেছে তারা এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে আর প্রেমিক প্রেমিকা যুগলকে হেনস্থা করবে না। বীরপুঙ্গব সুরেন্দর মিশ্র ও রাকেশ ভার্মা জানিয়েছেন পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাবের বিরুদ্ধে তাদের এই চিরাচরিত প্রতিবাদ এবার শুধু ভ্যালেন্টাইন্স কার্ড জ্বালানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। শিবশেনার আদিত্য ঠাকরের গলাতেও এবছর একই রকম সুর শোনা যাচ্ছে। তবে এই শাঁকের আঁটি কোন মাছ ঢাকতে তা নিয়ে এখনও ভাবনা চিন্তা করা হয়নি।


রসিক নাগর কমরেড চোপড়া ও আমাদের ভালোবাসার স্মৃতিময় লুল্লুড়ি

১৯৯১ সালে নরসিমা রাও আর মনমোহন সিংহের এনে দেওয়া ইকোনমিক লিবেরালাইজেশানকে জনমানসে ছড়িয়ে দিতে অনেকটা সেচ্ছাসেবক হিসাবে প্রথম নাম লেখায় বলিউড। তবে এখানে আমরা হিন্দি সিনেমা-বলিউড-ইন্ডিয়ান ডায়াস্পোরা এসব জটিল তত্তে যাচ্ছি না আমারা ছিলাম বিশ্বায়ন উত্তর নব প্রেম দিবস ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে। যাকে উজ্জাপন করতে হিন্দি ছবি আমাদের শৈশবে নিয়ে আসে একরঙা সিফন শাড়ি,  সুইজারল্যান্ড, লেদার জ্যাকেট, সল্মনের পায়রা, আমিরের বাবরি, ঋষি কাপুরের সোয়েটার শাহরুখের বগল আরও কত কী।মেট্রোতে ২০০০ সালে মোহাব্বতে রিলিজ হয়।তখন শীতকালমেট্রোর অবস্থা এখনকার মত ভাঙ্গাচোরা ছিল না। মেন গেট অবধি লাল কার্পেট বিছানো থাকত। ১৭ বছর পর এখন হলে মোহাব্বতে দেখার আর কোনো স্মৃতি মনে না থাকলেও একটা ঘটনা বেশ স্পষ্ট মনে আছে, ছবি ভাঙ্গার পর একজন দুজন না দলে দলে সবাই হল থেকে বেরোচ্ছে সোয়েটার খানি গলায় বেঁধে রাজ আরিয়ান হয়ে। বগল প্রসঙ্গে পুরন্দর ভাট লিখে গেছেন-

"সাবান মাখিয়া চান করি

পাউডারে উঠিয়া সাজিয়া,

কবে তুমি উঠিবে বাজিয়া?"

সে বগল বাজুক বা নাই বাজুক সেই বসন্তের ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে ওভাল চশমায় 'হামকো হামিসে চুরালো' রুপে সবাই জানিয়েছিল তাদের কল্পপ্রেম বিপ্লব। বহু বছর পর এখন যখন ভাবি যে গটা সিনেমাটা জুড়ে অশরীরী ঐশ্বর্যের সাথে শাহরুখ প্রেম চালিয়ে গেল, নেচে গেল, কথা বলে গেল, এমনকি ছবির শেষে জাঁদরেল বচ্চনকেও কনভিন্স করে ফেলল তবু আমরা সব কিছু হাসি মুখে মেনে নিয়ে সাইকো বলে গাল দিই বেচারা নরম্যান বেট্সকে।হেল যশ চোপড়া!

 

তেল জাপানি নিজেরে চিনি

আমাদের বয়েজ স্কুলের সবেধন নীলমণি পিসিও টি ছিল ফেব্রুয়ারী মাসের পরিবর্তিত খেলার মাঠ। ঠাকুমার ব্যাগ ঝেড়ে, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে সেই বুথ থেকে জমে উঠেছিল প্রেমটা। টিউশানের বন্ধুর, বান্ধবীর বোন। প্রথন কদিন ভায়া মাধ্যমে চিঠি চালাচালি হল তার পর শুরু হল ফোনালাপ। সেক্সচ্যাট জিনিসটা তখনও মফস্বলে পপুলার হয়নি। 'তুমি না খুব দুষ্টু' তেই আধা অরগ্যাজম। এমতাবস্থায় ঠিক হল ভ্যালেন্টাইন্স ডের দিন দেখা হবে দুজনায়। রবিবার, তাই স্পেশাল ক্লাসের নাম করে সকাল সকাল সেজে গুজে বেরিয়ে পড়লাম। সাধের লভে সাধ্যটাকে অনেকখানি ঠেলে দিয়ে ঈয়াব্বড় একটা ডেয়ারি মিল্ক কিনলাম। আর্চিসের মিউজিক কার্ডটা কেনার পয়সা নেই বলে আঁকাজোঁকার বিদ্যেটা কাজে লাগিয়ে নিবারণ চক্কোত্তির চোখা পাঁচটা লাইন ঝেড়ে কার্ডটা বানিয়েছিলাম আর রিবন দিয়ে মোড়া নতুন খাপে পুরনো একটা বাছাই কুমার শানু মিক্স। প্রছন্ড এক্সাইটেড স্বভাবতই সময়ের খানিক আগেই পুর্বনির্ধারিত জায়গায় এসে পোঁউছালাম বলতে দ্বিধা নেই বেশ ভয় ভয় ই করছিল। খানিকক্ষণ পর দূর থেকে যাকে আসতে দেখলাম ফোনের গলা শুনে আমি যে কল্পনা করেছিলাম তার সাথে কোন মিলই খুঁজে পেলাম না...অথচ সে সোজা এদিকেই এগিয়ে আসছে...আর কিছুতেই সাহস জোটাতে পারলাম না, সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিলাম, একবার পিছন ফিরে দেখলামও না... তার পর আর কোনদিন তাকে ফোন করি নি, সে আমার ফোন নম্বরও জানত না... বন্ধুরা বলল "ঠিকই করেছিস" , বিজ্ঞ সিনিয়াররা বলল "ওরকমটা হয়"... আমি আজও জানি না সেদিন 'সে'ই, 'সে' ছিল কিনা, শুধু এটুকু জানি সেদিন আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম যে বাই ডিফল্ট আমরা কতখানি 'সেক্সিস্ট' ও 'রেসিস্ট'।

 

কারো ভাদ্রমাস কারো ডটেড দীর্ঘশ্বাস

তারপর অনেক বসন্ত এসেছে গেছে, বাঙ্গালী আগে শুধু সরস্বতী পূজা করত, এখন দিল তো পাগল হ্যায় উত্তর ভ্যালেন্টাইন্স ডে ও দিলয়ালে দুলহানিয়া উত্তর 'করভা চউথ' ও পালন করে। আর্চিসের কার্ড আর মিক্স টেপ আজ ধীরে ধীরে হোয়াটসঅ্যাপ আর স্ন্যাপচ্যাটের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। চকলেট ডে তে স্ট্রবেরী বা এক্সট্রা ডট চাইতে গেলে দোকানদারও চোখ পাকায়। পপকর্ন জার্নালিসম ফিডিং বোতলে করে শিখিয়ে দিচ্ছে 'টুএলভ থিংস ইউ শুড ডু তো ইমপ্রেস ইওর পার্টনার'। ক্যাপিটালিসম রোজ তার পুরুষতন্ত্র কে নতুন মেকওভার করিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরছে আর আমরা তা চিনতে না পেরে আপন করে নিয়ে ভাবছি "বাঃ এই তো বেশ লিবারাল হয়ে গেলাম"।আমরা হুজুগে বাঙ্গালীরা 'উদয়ন','সারদা','ডিমনিটাইজেশান', 'নাজিব', 'যাদবপুর' সবের খিচুড়ি বানিয়ে হ্যাশট্যাগের পাঁপড় আর এবিপি আনন্দের আচার সহযোগে খেয়ে মহাতৃপ্তিতে শীতভাতঘুম দিচ্ছি, আর ইন্টেলেকচুয়ালরা হুজুগেদের খিস্তি করে ভার্চুয়াল পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। শুধু এতশত’র মাঝে লক্ষ লক্ষ ভ্যালেন্টাইনের স্মৃতি বুকে ধরে সিঙ্গেল স্ক্রীনের বক্স গুলো আর একাকী পিসিও বুথেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগে শেষ দীর্ঘ নিঃশ্বাসটুকু ত্যাগ করছে।।

মন্তব্যসমূহ